
ঢাকা, ২৪ জুলাই ২০২৫:
ভারত সরকার সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে শত শত বাঙালি মুসলিমকে বেআইনিভাবে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থাটি জানিয়েছে, যথাযথ আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে এসব মানুষকে “অবৈধ অনুপ্রবেশকারী” বলে চিহ্নিত করে সীমান্ত পার করে দেওয়া হচ্ছে।
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনটি বুধবার এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায়, ২০২৫ সালের মে মাস থেকে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) পরিচালিত সরকার এই বিতাড়ন প্রক্রিয়া আরও জোরদার করেছে। ফেরত পাঠানো ব্যক্তিদের অনেকেই ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর বাসিন্দা ছিলেন।
এইচআরডব্লিউ-এর এশিয়া পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেন, “সরকার যেভাবে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর কথা বলছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ এতে ন্যূনতম আইনগত অধিকার ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানা হচ্ছে না।” তিনি আরও বলেন, “বিজেপি নির্বিচারে বাঙালি মুসলিমদের দেশ থেকে বের করে দিয়ে বৈষম্যের আগুনে ঘি ঢালছে, এমনকি প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকরাও এর শিকার হচ্ছেন।”
সংস্থাটি জানায়, জুন মাসে তারা অন্তত ৯টি ঘটনার সাক্ষ্য সংগ্রহ করেছে এবং ১৮ জন ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলেছে, যাদের মধ্যে ভারতীয় নাগরিকও ছিলেন। তাঁদের কিছুজনকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, পরে তাঁরা প্রমাণসহ ভারতে ফিরে আসেন।
এ বিষয়ে গত ৮ জুলাই ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠালেও সংস্থাটি কোনো উত্তর পায়নি।
অন্যদিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানায়, ৭ মে থেকে ১৫ জুনের মধ্যে অন্তত ১,৫০০ মুসলিম পুরুষ, নারী ও শিশুকে ভারত বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১০০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী ছিলেন। বিতাড়নের এই প্রক্রিয়া এখনও চলছে বলে জানায় বিজিবি।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিজেপি-শাসিত রাজ্য যেমন আসাম, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, গুজরাট, ওড়িশা ও রাজস্থান থেকে অধিকাংশ দরিদ্র মুসলিম অভিবাসী শ্রমিকদের আটক করে বিএসএফের মাধ্যমে সীমান্তে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
অনেকক্ষেত্রে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) আটক ব্যক্তিদের অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে, মারধর করে বা হুমকি দিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
এপ্রিল মাসে জম্মু ও কাশ্মিরে হিন্দু পর্যটকদের ওপর হামলার পর মুসলিমদের বিরুদ্ধে হয়রানি বাড়ে। এরপর মে মাসে আসাম থেকে প্রায় ১০০ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, ভারত আরও ৪০ রোহিঙ্গাকে লাইফজ্যাকেট দিয়ে সাগরে ছেড়ে দেয় এবং মিয়ানমারের উপকূলে পৌঁছাতে সাঁতরাতে বলে। জাতিসংঘের মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুজ এটিকে “মানবতার চরম লঙ্ঘন” ও “নন-রিফাউলমেন্ট নীতির সরাসরি লঙ্ঘন” হিসেবে অভিহিত করেন।
বাংলাদেশ সরকারও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। গত ৮ মে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারত সরকারকে পাঠানো চিঠিতে স্পষ্ট জানায়, শুধু সুনির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশি হিসেবে শনাক্ত হওয়া ব্যক্তিদেরই আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গ্রহণ করা হবে। কোনো ধরনের ‘পুশ-ইন’ গ্রহণযোগ্য নয়।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট রোহিঙ্গা বিতাড়ন ঠেকাতে গত মে মাসে আবেদন নাকচ করে জানায়, যারা ভারতের নাগরিক নয়, তাদের ফেরত পাঠানো যাবে। যদিও ১৬ মে আদালত রোহিঙ্গাদের সমুদ্রে পাঠানোর ঘটনা “সাজানো গল্প” বলে উড়িয়ে দেয়, তবে সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘটনাটি অস্বীকার করেনি।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দাবি, ভারতের এ ধরণের কার্যকলাপ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, জাতিগত বৈষম্য বিলোপ কনভেনশন এবং নাগরিক অধিকার সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক চুক্তিগুলোর সরাসরি লঙ্ঘন। আইন অনুযায়ী, কাউকে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার আগে তাকে কারণ জানানো, আইনজীবীর সহায়তা পাওয়ার সুযোগ এবং সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করার অধিকার থাকা উচিত। একইসঙ্গে আটক ব্যক্তিদের খাদ্য, চিকিৎসা, আশ্রয় এবং ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর (নারী, শিশু, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী) জন্য বিশেষ সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টিও বাধ্যতামূলক।