
দক্ষিণ এশিয়ার হিমালয় কন্যা নেপাল ইতিহাসের অন্যতম বড় রাজনৈতিক সঙ্কটে পড়েছে। টানা দুই দিনের সহিংস বিক্ষোভে টালমাটাল হয়ে মঙ্গলবার অবশেষে পদত্যাগ করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি।
ঘটনার সূত্রপাত সরকারের সিদ্ধান্তে একযোগে ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করার নির্দেশ থেকে। সরকারের দাবি ছিল, এসব প্ল্যাটফর্ম নিবন্ধনবিহীন এবং ভুয়া তথ্য ও প্রতারণার মাধ্যমে জনস্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তবে সমালোচকরা বলছেন, আসল উদ্দেশ্য ছিল দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে তরুণদের কণ্ঠরোধ করা।
জেন-জি আন্দোলনের সূত্রপাত
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে সোমবার সকাল থেকে তরুণ-তরুণীরা রাস্তায় নামে। ‘জেন-জি আন্দোলন’ নামে পরিচিত এই বিক্ষোভ দ্রুত দেশজুড়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। কাঠমান্ডুতে হাজারো তরুণ একত্রিত হয়ে স্লোগান তোলে— “দুর্নীতি বন্ধ করো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নয়”, “তরুণরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে”।
তরুণদের মতে, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিক ও আমলাদের বিলাসী জীবনযাপন ফাঁস করার প্রধান মাধ্যমই ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। নিষেধাজ্ঞা কার্যত তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে।
সহিংসতায় রূপ
প্রথমে শান্তিপূর্ণভাবে শুরু হলেও আন্দোলন দ্রুত উত্তেজনায় রূপ নেয়। সংসদ ভবন ঘেরাও করে বিক্ষোভকারীরা। একপর্যায়ে তারা ভেতরে প্রবেশ করলে নিরাপত্তা বাহিনী কাঁদানে গ্যাস, জলকামান ও সরাসরি গুলি চালায়। সোমবার রাত পর্যন্ত সরকারি হিসেবে ২০ জন নিহত ও আড়াই শতাধিক আহত হয়। মঙ্গলবারও সংঘর্ষে আরও একজন নিহত হন।
রাজধানীর বাইরে পোখারা, বুটওয়াল, ভরতপুর, ভৈরাহাওয়া, ইতাহারি ও দামাকসহ বিভিন্ন শহরে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে একাধিক জেলায় অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারি হয়।
সরকারের ওপর হামলা
মঙ্গলবার বিক্ষোভকারীরা সংসদ ভবনের কিছু অংশে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং শীর্ষ নেতাদের বাড়িঘরে হামলা চালায়। নিশানায় পড়েন প্রধানমন্ত্রী অলি, প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পাউডেল, নেপালি কংগ্রেস নেতা শের বাহাদুর দেউবা ও মাওবাদী নেতা পুষ্প কমল দহল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরজু দেউবা রানার মালিকানাধীন একটি স্কুলেও আগুন দেওয়া হয়।
নিরাপত্তাহীনতায় মন্ত্রীদের সরিয়ে নিতে সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করা হয়। ১২টি সামরিক উড়োজাহাজে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নিরাপদ স্থানে নেওয়া হয়। একই সঙ্গে রাজধানীর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সব ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়।
শেষপর্যন্ত অলির পদত্যাগ
সহিংস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে মঙ্গলবার রাতে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন অলি। তিনি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খোঁজার আহ্বান জানান। তবে সেনাপ্রধান আশোক রাজ সিগদেলের সঙ্গে বৈঠকে অলি জানতে পারেন, তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করলে সেনাবাহিনী হস্তক্ষেপ করবে না। চরম চাপে পড়ে শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন অলি। এর মাধ্যমে তার চতুর্থ মেয়াদের সমাপ্তি ঘটে।
পদত্যাগের আগে অলি নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দেওয়ার ঘোষণা দেন। তবে তার পদত্যাগের পর এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
সরকারের ভাঙন
অলির মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ লেখক, কৃষিমন্ত্রী রামনাথ অধিকারী, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী তেজু লাল চৌধুরী, পানি সম্পদমন্ত্রী প্রদীপ যাদব ও সংসদ সদস্য আসিম শাহ পদত্যাগ করেছেন।
ক্ষমতাসীন জোটও ভাঙনের দ্বারপ্রান্তে। নেপালি কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতা শেখর কৈরালা সমর্থকদের সরকার ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন। মাওবাদী সেন্টার, জনতা সমাজবাদী পার্টি এবং ন্যাশনাল ইনডিপেন্ডেন্ট পার্টিও (এনআইএসপি) জোট ত্যাগের হুমকি দিয়েছে। ফলে সংসদে সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা
সেনাবাহিনী আপাতত সরাসরি ক্ষমতা নেওয়া থেকে বিরত থাকলেও নতুন সরকার বা আগাম নির্বাচনের দাবি তোলেছে বিরোধীরা। এদিকে, তরুণ বিক্ষোভকারীরা এখনও রাস্তায় অবস্থান করছেন এবং কার্যকর রাজনৈতিক সংস্কার না আসা পর্যন্ত পিছু হটার কোনো ইঙ্গিত দেননি।